Islamic Views

শিশু-কিশোর লালন-পালনে ইসলামের দিকনির্দেশনা কি?

ইসলাম শিশুদের অধিকার ও কল্যাণের বিষয়টির ওপর যতটা জোর দিয়েছে, আর কোনো ধর্ম তা দেয়নি। শিশু-কিশোরদের শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশ ইসলামে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলাম মনে করে এই প্রজন্মের উন্নত ও যথাযথ বিকাশের ওপরই একটি মর্যাদাশীল জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। একটি শিশুর জন্ম হবে একটি পরিবারে। আর সেই পরিবার তাকে সাদরে গ্রহণ করবে। শুধু তা-ই নয়, পরিবারটি শিশুটিকে ইসলাম শিক্ষা ও বিধানের আলোকে গড়ে তুলবে এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাত থেকে তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেবে। এ কথা বলা অনাবশ্যক যে শিশুদের ভালোভাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব তাদের মা-বাবার। কোরআন ও হাদিসে এ ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও অনেক মুসলিম পরিবার বিষয়টির প্রতি তেমন কোনো গুরুত্ব দেয় না। অনেকে আবার এটাকে তাদের জীবনবিধানের অতি প্রয়োজনীয় বিষয় বলেও ভাবতে পারে না। সব মুসলমানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিষয়টি সত্য। ইসলামের বিধান মতে, মুসলিম শিশু-কিশোররা এবং তাদের মা-বাবা উভয়ে এমনভাবে ইসলামের বিধান মতে চলবে, যাতে মৃত্যুর পর তারা দোজখের শাস্তির মুখোমুখি না হয়। ইসলাম সব মুসলমানের বেলায় স্ব স্ব দায়িত্ব পালনকে বাধ্যতামূলক করেছে। এ ব্যাপারে মুসলমানদের সতর্ক করে কোরআনের নির্দেশও এসেছে। আল্লাহ তায়ালা সুরা তাহরিমের ৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন, 'যারা ইমান এনেছ, তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে দোজখের সে আগুন থেকে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যেখানে নিয়োজিত রয়েছে কঠোর স্বভাব ও শক্তিমান ফেরেশতারা, যারা আল্লাহ যা আদেশ করেন তার নাফরমানি করেন না, আর তারা তাই করে, যা তাদের করতে আদেশ করা হয়।'
শিশু-কিশোরদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও পরিচালনার মাধ্যমে গড়ে তোলার ওপর জোর দিতে গিয়ে আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, 'শিশু-কিশোরদের জন্য তার বাবার পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় উপহার এটাই যে তিনি তাদের যথাযথভাবে বড় করে গড়ে তুলবেন।'

শিশু-কিশোরদের কল্যাণ
উল্লিখিত কোরআন ও হাদিসের নির্দেশিকা থেকে এটা স্পষ্ট যে শিশু-কিশোরদের লালন-পালন ও যথাযথ গঠন ইসলামে অতি জরুরি কাজ। হামুদা আবদালতি তার বই 'ইসলাম ইন ফোকাস'-এ উল্লেখ করেছেন, হজরত মুহাম্মদ (সা.) শিশুদের ভালোবাসতেন। তিনি বলেছেন, আমার মুসলিম মিল্লাত এ জন্য অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ যে তারা শিশুদের অধিক ভালোবাসে। তাই শিশুদের অধিকারের বিষয়টিকে প্রধান দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। মহানবী (সা.)-এর আদেশ অনুযায়ী শিশুর জন্মের সাত দিনের মাথায় তার একটি ভালো ও সুন্দর নাম রাখতে হবে। তার মাথা মুণ্ডিয়ে দিতে হবে এবং তার স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য যাবতীয় স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ কাজটিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে অতিরিক্ত কিছু করাকে ইসলাম অপছন্দ করেছে। তবে দিনটিকে আনন্দঘন ও উৎসবমুখর করার জন্য একটি ভেড়া বা ছাগল কোরবানি করা যেতে পারে এবং তার গোশত গরিবের মাঝে বিতরণ করা যেতে পারে। মহানবী (সা.) এটা অনুমোদন করেছেন যে শিশু ছেলে হলে সে ক্ষেত্রে দুটি এবং মেয়ে হলে সে ক্ষেত্রে একটি ভেড়া বা ছাগল কোরবানি করা যায়। এই আনন্দঘন উৎসব ছাড়াও পরিবারে পিতার দায়িত্ব হচ্ছে শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য যাবতীয় বস্তুগত জিনিসের জোগান দেওয়া। আর শিশুর স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবেন তার মা। ইসলামী দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের অভিমত হলো, শিশুর মানসিক ও ধর্মীয় বিকাশে মা-বাবা অবশ্যই সঠিক দায়িত্ব পালন করবেন। নবী করিম (সা.) তাই তাগিদ দিয়েছেন যেন মা-বাবা শিশুর সাত বছর বয়স থেকে তাকে নামাজের তাগিদ দেন। আর ১০ বছর বয়স থেকে শিশু-কিশোররা যদি নামাজ পড়তে শুরু না করে, তাহলে তাদের শায়েস্তা করারও নির্দেশ দিয়েছেন মহানবী (সা.)। এখানে উল্লেখ্য, মা-বাবা ততক্ষণই শিশু-কিশোরদের কল্যাণের দায়িত্ব পালন করবেন যতক্ষণ না তারা সাবালক হয়; অর্থাৎ তারা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করে। তারপর মা-বাবা তার সন্তানদের সাধারণ ভরণপোষণ, খাবার, আশ্রয় এবং আলাদা থাকার ব্যবস্থা করবেন। এ ছাড়া শিশুর নিরাপত্তার যাবতীয় ব্যবস্থা নেবেন।

শিশু-কিশোরদের অধিকার
শিশু-কিশোরদের শিক্ষা ও শারীরিক বিকাশের কথা নবী করিম (সা.) উল্লেখ করেছেন। একবার হজরত সালমান (রা.) মুহাম্মদ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের শিশুদের প্রতি যে দায়িত্ব আছে, সেভাবে তাদেরও কি আমাদের ওপর কোনো দায়িত্ব আছে? মহানবী (সা.) বলেছেন, 'আছে। মা-বাবার পক্ষ থেকে শিশুদের প্রতি দায়িত্ব হলো, তাদের লেখাপড়া, সাঁতার কাটা ও ধনুর্বিদ্যা শেখানো।' অন্য এক হাদিসে নবী করিম (সা.) প্রত্যেক ইমানদার মানুষের ওপর জ্ঞানার্জনকে অত্যাবশ্যকীয় করেছেন। তাই শিশুদের শিক্ষিত করে তোলা আমাদের বিরাট এক দায়িত্ব। শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে মহানবী (সা.) বলেছেন, 'তোমরা দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন করো।' শিশুদের শিক্ষা শুরু হয় তার মা-বাবার কাছ থেকে। তাই মা-বাবার কাজ হচ্ছে শিশুর শিক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা এবং প্রথমে তাকে কোরআন শিক্ষা দেওয়া। এতে শিশু এমনভাবে বেড়ে উঠবে, যাতে ইসলামই সব সময় তার জীবনের অঙ্গ হয়ে থাকবে। তারা কোনোভাবেই আর বিভ্রান্ত হবে না। কেননা, তার শিক্ষার আলোই তাকে সঠিক রাস্তায় পরিচালনা করবে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, কয়টি মুসলিম পরিবার ইসলামের এই গুরুদায়িত্ব পালন করছে? অধিকাংশ পরিবারই এই দায়িত্ব থেকে বিমুখ হয়ে আছে। তারা তাদের শিশু-কিশোরদের প্রয়োজনীয় শিক্ষায় শিক্ষিত না করার কারণে মুসলিম সমাজ ও পরিবারে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ইসলাম আলো ও শান্তির ধর্ম। এটা অজ্ঞতাকে কোনোভাবেই পছন্দ করে না। ইসলাম চায় মা-বাবা তার দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে জানুক এবং সেই মতে তার পারিবারিক কর্তব্য পালন করুক। শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার বিষয়টিকে নিশ্চিত করার জন্য নবী করিম (সা.) তাই বলেছেন, 'তোমার বংশধরদের অন্যের ওপর নির্ভরশীল করে রেখে যাওয়ার চেয়ে তাদের অপেক্ষাকৃত সচ্ছল রেখে যাওয়া অনেক ভালো।' আজকাল এটা খুব উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, সন্তান-সন্ততি এখন আর মা-বাবার জন্য আনন্দের কোনো বিষয় বলে বিবেচিত হচ্ছে না। যদিও আল্লাহপাক পবিত্র কালামে পাকে তাদের পরম রহমতের বিষয় বলে বর্ণনা করেছেন। আর এটা ঘটছে মা-বাবার চরম অবহেলা ও অবিবেচনার জন্য। কোরআনে পাকের সুরা ফুরকানের ৭৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, 'এবং যারা কামনা করে, হে আমাদের রব! আমাদের দান করো এমন স্ত্রী এবং সন্তান-সন্ততি, যারা হবে আমাদের জন্য নয়নপ্রীতিকর এবং আমাদের করো মুত্তাকিদের জন্য অনুসরণযোগ্য।' অনেক মা-বাবাই তার সন্তানের জন্য সব কিছুই করে যাচ্ছেন। কিন্তু তা তারা করছেন ভুলপথে, ভুলভাবে। সন্তান-সন্ততিকে সুষ্ঠু ও সুন্দর আচার-ব্যবহার শিক্ষা দেওয়ার প্রধান ও প্রথম দায়িত্ব মায়েদের ওপর। তাদের সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার যাবতীয় কর্তব্য পালন করবেন ছেলেমেয়েদের মায়েরা। কিন্তু তারা আজকাল অফিস-আদালতের কাজকর্ম বা অন্য কোনো সামাজিক ও সাংসারিক দায়িত্ব পালনে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে এসব জরুরি বিষয়ে তারা সময়ই দিতে পারেন না। তাদের মধ্যে বস্তুজগতের চিন্তাভাবনা এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে মায়েরা তাদের পবিত্র দায়িত্ব ছেড়েই দিয়েছেন। আজকালকার মায়েরা তাদের সন্তানের লালন-পালনের দায়িত্ব বাসার কাজের বুয়াদের ওপর অথবা ধাত্রীদের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকার চেষ্টা করছেন। তারাই তাদের সন্তানের খাওয়াদাওয়া, স্কুলে আনা-নেওয়ার যাবতীয় বিষয় দেখাশোনা করে থাকে। আর শিশু-কিশোরদের ধর্মীয় দিকটি অনেক মা আজকাল একবারেই বাদ দিয়েছেন। এভাবে শিশু-কিশোর সন্তান-সন্ততিকে ইসলামী বিধানের আলোকে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে আমরা আমাদের সন্তান-সন্ততির ভবিষ্যৎকে শুধু অবহেলাই করছি না, আমরা তাদের জীবনকেই ধ্বংস করার পথ সুগম করছি। কেননা, একটা শিশুর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সে কতটা সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে গড়ে উঠছে তার ওপর। আমরা আমাদের শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ ও সুস্থ জীবনের খাতিরে তাদের পজিটিভ ও গঠনমূলক মানসিকতা নিয়ে গড়ে তোলার চেষ্টা চালাতে হবে। আর এটা আমাদের ওপর কোনো সাধারণ কর্তব্য নয়। এ দায়িত্ব ও কর্তব্য মহান আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত একটি বড় জরুরি ও পবিত্র দায়িত্ব। আমাদের সবার এ কথা মনে রাখতে হবে যে এ দায়িত্ব পালনের জন্য শেষ বিচারের দিন আল্লাহর কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে। এ ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছেন, 'তোমাদের প্রত্যেককে তার দলের বা নির্ভরশীলদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হবে। পিতা হচ্ছে পরিবারের প্রধান এবং তিনি তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। স্ত্রীরা হচ্ছেন স্বামীর সংসারের দায়িত্বশীল। তিনি তার অধীনে যা আছে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন।' কাজেই আমাদের সবাইকে সন্তান-সন্ততির জীবন গঠনে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে, যাতে একটি সুন্দর পরিবার, সুন্দর সমাজ ও সর্বোপরি একটি আদর্শ রাষ্ট্র গড়ে উঠতে পারে এবং এর মাধ্যমে একটি শান্তি-সহমর্মিতাময় সমাজের ভিত্তি তৈরি হয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে এ মহান কর্তব্য পালনে সহায় হোন।

1 comment:

  1. বিষয়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ... আমরা কি আমাদের সন্তানকে সঠিকভাবে লালনপালন করছি কিনা বা তার অধিকার ঠিকমত আদায় হচ্ছে কি আমাদের ভেবে দেখা উচিৎ

    ReplyDelete

পরামর্শ প্রার্থনীয়

^ Back to Top Blogger Widgets